জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ও নিজের ভাই শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করত। বিলাস-বেশনে তার দৃষ্টি ছিল না। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও অর্থের প্রতি আকর্ষণ ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ-সম্পদে তার নজরই ছিল না।
বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে শহিদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন ও শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার-২০২১ প্রদান অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছোট ভাই শেখ কামালের স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কামাল আমার ছোট ভাই। আমরা দুই ভাইবোন পিঠাপিঠি। এক সঙ্গে বড় হয়েছি, এক সঙ্গে চলতাম। খেলাধুলা, পড়ালেখা ও ঝগড়াও করেছি। ভালো বোঝাপড়া ছিল আমাদের মধ্যে। যে কোনো কাজে আমার সঙ্গে পরামর্শ করত। একরকম নির্ভর করত আমার ওপর। বাবার স্নেহ থেকে সে বঞ্চিত ছিল। যার কারণে মনে অনেক আক্ষেপ ছিল। আব্বা তাকে আদরও করতেন বেশি। কামালের অনেক গুণ ছিল। সে যে কাজেই হাত দিত, সেখানে তার মেধার স্বাক্ষর রেখে আসত। কামাল সেতার বাজানো শিখতো, সে চর্চা সে রেখে গিয়েছিল। পাশাপাশি চমৎকার নাটক করতে পারত। ঢাবিতে পড়তে অনেক নাটক করেছে। ক্রীড়া জগতে তার অবদান অনেক। আবাহনী ক্রীড়াচক্র গড়ে তোলে। ধানমণ্ডি অঞ্চলের শিশু ও কিশোরদের খেলাধুলার জন্য এই চক্র গড়ে তোলে কামাল।’
তিনি বলেন, ‘কামাল ঘরে ঢুকলে গান গাইতে গাইতে আসত। বোঝা যেত কামাল আসছে। স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী সে গড়ে তোলে। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করত। অদ্ভুত সাংগঠনিক দক্ষতা ওর মধ্যে ছিল। ঢাবিতে ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে চলতে পারায় কামালের অবদান আছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাবাকে তো প্রায় গ্রেফতার করা হতো। ছয়দফা দেয়ার পর কামালের আন্দোলনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আসলে আজকে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গণে যে আধ্যাত্মিক বা ফোক গান আধুনিক সঙ্গীতের সঙ্গে সুর করে প্রচার করা হয়, এতে কামালের অবদান ছিল। আজকে যেটি প্রাসঙ্গিক। উপস্থিত বক্তৃতায়ও কামাল পারদর্শী ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমার দাদা, বাবা ফুটবল খেলতেন। খেলাধুলার প্রতি পারিবারিকভাবেই আমাদের আগ্রহ ছিল। কামালও খেলায় পারদর্শী ছিল। যুবসমাজকে সুসংগঠিত করার অনেক কাজ করে গেছে কামাল। বেঁচে থাকলে হয়তো যুবকদের জন্য আরও কিছু করত।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচনে মানুষকে সম্পৃক্ত করা ও প্রচার প্রচারণা চালানোয়ও কামাল ভালো করেছে। সেসময় একজন একভোট ছিল, নির্বাচনে ভোটের প্রশিক্ষণ দিতে হতো। কামাল সে প্রশিক্ষণ দিত। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কামাল কাজগুলো করেছিল। ৭ মার্চের ভাষণের সময়ও মঞ্চে কামাল ছিল। সেখানেও সুসংগঠিত করার কাজ করেছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই ধানমন্ডি এলাকায় যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যারিকেড দেয়ার কাজটি সে করে। আব্বাকে গ্রেফতারের পরে সে রাতেই সে ২৫টি বাড়ির ৫০টি দেয়াল টপকে বাসায় মাকে দেখতে আসে। আবার চলে যায়। সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। বাংলাদেশ সরকার কয়েকজনকে ওয়ার ট্রেনিং দেয়, সেখানেও কামাল ছিল। পরে তাকে ওসামনির এডিসি নিয়োগ দেয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডির ৯/এ ২৬ নম্বর বাসায় আমাদের আটকে রাখা হয়। ১৭ তারিখে আমরা মুক্তি পাই। কামাল, জামাল সন্ধ্যায় ফিরে আসে। রণাঙ্গণের পোশাক পরা ছিল। এরপর থেকে মায়ের কাছেই থাকে। মায়ের ইচ্ছে ছিল সে যেন পড়াশোনা শেষ করে। সে তখন ক্যাপ্টেন ছিল। মায়ের ইচ্ছায় রিজাইন করে আবার পড়াশোনা করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কামাল সবকিছু আন্তরিকতার সঙ্গেই করে। ক্রীড়াঙ্গণকে ঢেলে সাজায়। সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক জগতে তার অবদান আছে। ৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটা চক্রান্ত করে তাকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। যখন সে বেঁচে যায়, তার বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটানো হয়। অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করত। বিলাস-বেশনে তার দৃষ্টি ছিল না। রাষ্ট্রপতির ছেলে হয়েও অর্থের প্রতি আকর্ষণ ছিল না। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ-সম্পদে তার নজরই ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘১৪ জুলাই কামালের ও ১৭ জুলাই জামালের বিয়ে হয়। আমরা যাচ্ছিলাম বাইরে (দেশের), জিজ্ঞাসা করলাম তোমার জন্য কী আনবো? বললো, আমার জন্য না, আমার আবাহনীর খেলোয়াড়দের জন্য বুট নিয়ে এসো। তখন ডায়েরিতে নামটাও লিখে দেয় এডিডাসের বুট। সেখান থেকেই বোঝা যায় তার নিজের জন্য কিছুর আগ্রহ ছিল না।’
পরিবারের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘বারবার যাকে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা হলো, হত্যার চেষ্টা হলো। অথচ তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিলেন। একটি পতাকা দিলেন। একটা জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের সুযোগ দিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলেছেন। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী সবই সীমিত শক্তির মধ্যে গড়ে তুলেছেন। অথচ এদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ ষড়যন্ত্র করে কী নির্মমভাবে হত্যা করল। সবচেয়ে ট্র্যাজেডি কামালের জন্য। যে নূর কামালের সঙ্গে ওসমানির এডিসি হিসেবে কাজ করেছে। যখন বাসায় আক্রমণ করে কামাল নিচে বারান্দায় চলে যায়। ও যখন দেখে যে, নূর হুদা এক সঙ্গে ঢুকছে, ও তাদের বলে আপনারা এসে গেছেন? খুব ভালো হয়েছে। দেখেন বাসায় কারা আক্রমণ করছে। এই কথা শেষ করতে পারেনি। ওই নূরের হাতের অস্ত্রই গর্জে ওঠে। ওরা ওখানেই কামালকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা এই বাংলাদেশে হয়ে গেছে!’
তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট যদি এই বাঙালির জীবনে না ঘটতো, তাহলে বাঙালি অনেক আগেই বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলতো। এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, যদিও সেটা টিকে নাই। তখন চক্রান্তটা কোথায় কীভাবে হয়েছিল, এখন এটা বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। আর কতটুকু বিশ্বাসঘাতকতা এটাও মানুষ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার আব্বা যেমন সারাজীবন এদেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সন্তান হিসেবে আমরাও পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়েছি। এটাকে কষ্ট মনে করিনি। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে হা-হুতাশও ছিল না। সাধারণভাবে জীবনযাপন ও মানুষের জন্য কিছু করার শিক্ষা আমাদের বাবা-মা দিয়ে গেছেন। সে শিক্ষা অনুসরণ করে সহজ জীবনযাপন করেছে কামাল। তার ও তার স্ত্রীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে যারা ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ক্রীড়াক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাক, সেটা চাই। কারণ একটা জাতির এগিয়ে যাওয়ার জন্য বা গড়ার জন্য শিক্ষা, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক চর্চা অপরিহার্য। আমাদের শিশু, কিশোর, যুবক ও সকলের মেধাকে কাজে লাগানো গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, এই পুরস্কারের মধ্যদিয়ে যেমন কামালের প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে, পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গণে মানুষের সম্পৃক্ততা আরও বাড়বে, উৎসাহী হবে, বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, বিশ্বসভায় মর্যাদা নিয়ে আসবে, সেটাই আমাদের কাম্য।’
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। এসময় দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ক্রীড়া পুরস্কার দেয়া হয়।