সাইবার অপরাধ দমনে আরএমপি সাইবার ইউনিটের অভূতপূর্ব সাফল্য

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ক্রমেই বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। একইসাথে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সম্পর্কিত অপরাধ বা সাইবার অপরাধ। ব্লাকমেইল, পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, ওয়েবসাইট হ্যাকিং, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং করে টাকা উত্তোলন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারসহ সাইবার অপরাধ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।

এসবের ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চাওয়া তো দূরের কথা সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তা প্রকাশ করা থেকেও পিছু হটেন অনেকেই। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নিজেই বুঝতে পারেন না তিনি অপরাধের শিকার হয়েছেন।

এসব অপরাধ দমনে ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) সাইবার ক্রাইম ইউনিট। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর নগরীর সাইবার অপরাধ নির্মূল ও সংঘটিত অপরাধের অপরাধীদের দ্রুত শনাক্তে পুলিশের স্বতন্ত্র এই ইউনিট কাজ শুরু করে। দেখতে দেখতে পথচলার দুই বছর পেরিয়ে তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করেছে নগর পুলিশের এই বিশেষ বিভাগ।

খোজ নিয়ে জানা যায়, আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে একজন সহকারী পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে ১ জন এসআই, ১ জন এএসআই এবং ৩ জন কনস্টেবলসহ মোট ৬ জন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সদস্যকে নিয়ে পথচলা শুরু করে ইউনিটটি। নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণে আরও কিছু প্রশিক্ষিত সদস্য যুক্ত হয়ে বর্তমানে ১ জন সহকারী পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে ৪ জন এসআই, ৩ জন এএসআই ও ১৬ জন কনস্টেবলসহ বিভাগের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪ এ।

সরাসরি অপারেশনাল টিম হিসেবে ফিল্ডে কাজ না করলেও ইউনিটটি আরএমপির সকল কার্যক্রমে বিশেষ করে সাইবার অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকরনসহ আসামি গ্রেফতারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। আরএমপি এলাকার সকল ক্লু-বিহিন ঘটনা উদঘাটন, অপরাধী শনাক্তকরন ও গ্রেফতার সহায়তায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে ইউনিটটি। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য জেলার সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত ঘটনার তথ্য দিয়েও সহায়তা করছে এই ইউনিট।

এ বিষয়ে জানতে কথা হয় আরএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার ও সাইবার ইউনিটের ইনচার্জ উৎপল কুমার চৌধুরীর সাথে। তিনি প্রতিবেদক কে বলেন, গত ২ বছরে রাজশাহী মেট্রোপলিটনসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে প্রায় ৮৬১টির মত ফেইসবুক সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগ এসেছে এই ইউনিটে। ফেইসবুক সংক্রান্ত অভিযোগের মধ্যে রয়েছে নারীদের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ছবি-ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে ব্লাকমেইল করা, ফেইসবুকে যে কারো ছবি দিয়ে ভুয়া একাউন্ট তৈরি করা, সোস্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ছেড়ে দিয়ে মানহানি করা, ফেইসবুক একাউন্ট হ্যাক করা, বিভিন্ন ভুয়া মেসেঞ্জারের মাধ্যমে পর্ণ ছবি ও ভিডিও পাঠানোসহ ফেইসবুকের মাধ্যমে সংঘটিত সকল অপরাধ।

এছাড়াও পূর্বে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কিন্তু বর্তমানে নেই তাই সাবেক প্রেমিক/প্রেমিকাকে হেনস্থা বা ব্লাকমেইল করার জন্য বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন ছবি/ ভিডিও প্রচার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফেইসবুক সংক্রান্ত প্রায় ৮৬১টি অপরাধের মধ্যে ৮৪০টির মত অপরাধ আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট নিষ্পত্তি করেছে।

মোবাইল ব্যাংকিং সম্পর্কিত অপরাধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ২ বছরে মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত প্রায় ৩৫৭টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেটসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ও আর্থিক ট্রান্সজেকশন/ ট্রান্সফার সিস্টেমের অপরাধ পাওয়া গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন ভুয়া অফারের মাধ্যমে পিন কোড নিয়ে বিকাশ একাউন্ট হ্যাক, ভুয়া রেজিষ্ট্রেশন, সংঘবদ্ধ অপরাধীদের বিকাশ, নগদ ও রকেট চক্রের পরিকল্পনা মাফিক ফাঁদসহ বিভিন্ন অপরাধ পাওয়া গেছে।

উৎপল কুমার চৌধুরী আরও বলেন, গত দুই বছরে ইমো/হোয়াটসঅ্যাপ/ই-মেইল সংক্রান্ত প্রায় ৫৮টির অধিক অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত অপরাধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইমো/হোয়াটসঅ্যাপ/ই-মেইল ব্যবহার করে সম্পর্ক স্থাপন ও আর্থিক প্রতারণার মত ঘটনা। এছাড়াও ই-মেইল হ্যাক করে বিভিন্ন অপ্রীতিকর তথ্য পাঠানো ও ভুয়া বা বেনামে মেইল আইডি খুলে বিভিন্ন অপরাধের সৃষ্টি।

তিনি বলেন, একই সময়ে টিকটক/লাইকি সংক্রান্ত মোট ১৫টি অভিযোগ এসেছে। যার সবগুলোই শনাক্ত পূর্বক নিষ্পত্তি করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অপরাধ হলো বিভিন্ন উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলা।

অপহরণের নিষ্পত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ২ বছরে এই ইউনিট প্রায় ১৫৩টির মত অপহরণের  অভিযোগ সংক্রান্তে ১৩৯ জন ভিক্টিম উদ্ধার করেছে। এছাড়াও অপহরণে জড়িত আসামি শনাক্তকরণ ও গ্রেফতারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে এই ইউনিট। অপ্রাপ্ত/অল্প বয়সী মেয়ে/ছেলেদের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে বিভিন্ন প্রলোভন, বিভিন্ন আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে তারা অপহরণ করতো।

হারানো বা চুরি-ছিনতাই হওয়া মোবাইল-ল্যাপটপ উদ্ধারের তথ্য উদঘাটনেও সফলতা রয়েছে আরএমপির এই বিশেষায়িত ইউনিটের। গত ২ বছরে ২ হাজার ৬০৭টি মোবাইল বা ল্যাপটপ উদ্ধার করার তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উৎপল কুমার চৌধুরী।

এছাড়াও নগরীর ক্লু-বিহীন ঘটনা ও সংঘবদ্ধ  অপরাধ ও অপরাধী শনাক্ত পূর্বক গ্রেফতারে প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিটটি। গত ২ বছরে নানা অপরাধের প্রায় ৪ হাজার ৪৩৬টি অভিযোগ/জিডি পায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট। এরমধ্যে ৪ হাজার ১৬৯টির মত অপরাধ/জিডি/অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আরএমপির নব গঠিত সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সফলতার হার প্রায় ৯৪ শতাংশ।

উৎপল কুমার চৌধুরী জানান, নগরীর কিশোর গ্যাং নির্মূলে ডিজিটাল ডাটাবেইজ তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে ইউনিটটি। বাংলাদেশের সকল ইউনিটের মধ্যে কিশোরদের সর্বপ্রথম ডিজিটাল ডাটাবেইজ তৈরি করেছে আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট। যেখানে নগরীর ৫১৫ জন কিশোরের তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়াও নগরীর ৯টির মত কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে ইউনিটটি। পাশাপাশি প্রতিদিন আরএমপির প্রত্যেকটি থানার মাধ্যমে ডাটাবেজ এ সংরক্ষিত কিশোরদের তদারকির ব্যবস্থাও করেছে এই ইউনিট।

এছাড়াও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর আরএমপি পুলিশিং সেবার অন্যতম বহুল তথ্য সম্বলিত “হ্যালো আরএমপি” এ্যাপ পরিচালনা করে আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট। এখানে যে কেউ পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন অভিযোগ ও তথ্য প্রদান করতে পারেন। নগর পুলিশের প্রয়োজনীয় সকল তথ্য এক ক্লিকেই পাওয়া যায় এই এ্যাপে। এর মাধ্যমে পাওয়া ২৯৫টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সার্বিক আইন শৃংখলা মনিটরিং, বিভিন্ন অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকণে নগর পুলিশের অপারেশন কন্ট্রোল এন্ড মনিটরিং সেন্টার সেন্ট্রাল সিসি ক্যামেরা ইউনিটও পরিচালিত হয় আরএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের মাধ্যমে। নগরীর প্রায় ৫০০ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন পূর্বক পুরো নগরীকে নজরদারিতে নিয়ে আসার মত কঠিন কাজও করে যাছে এই ইউনিট।

সাইবার ক্রাইম ইউনিট ইনচার্জ বলেন, এই ইউনিটের সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ৪৭৫টির অধিক চুরির ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও চোর শনাক্তকরণ, ৮২টির অধিক ছিনতাই ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও অপরাধী শনাক্তকরণ, ৬৮টির অধিক ইভটিজিংয়ের ঘটনায় অপরাধী শনাক্তকরণসহ কিশোর অপরাধ দমনে সার্বক্ষণিক মনিটরিং, ৯৩টির অধিক হারানো ঘটনার রহস্য উদঘাটন, ৩১টির মত অজ্ঞান পার্টি ঘটনার আসামি শনাক্তকরণ, ৫৩টির অধিক মারামারি ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ আসামি শনাক্তকরণ, ছেলে/মেয়ে হারিয়ে যাওয়া ও হারিয়ে যাওয়ার নাটক করাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি হারানোর ৫৫টি ঘটনার রহস্য উদঘাটন, ৭৫টি সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ শনাক্তকরণ, ২৩টির অধিক ক্লু-লেস মার্ডার মামলার রহস্য উদঘাটনসহ আসামি শনাক্তকরণ, ট্রাফিক কন্ট্রোল, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামের মিছিল/মিটিং/সমাবেশ/মানববন্ধন ও বিশেষ দিবসের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করেছে এই ইউনিট।

সম্প্রতি, U.S Embassy এর তত্ত্বাবধানে ATA(Anti Terrorism Assistance) এর আওতায় ও আরএমপির সহায়তায় সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়াও U.S Embassy ও আরএমপি কমিশনারের সার্বিক দিকনির্দেশনায় অত্যাধুনিক ফরেনসিক যন্ত্রপাতি/সফটওয়্যার, তথ্য-প্রযুক্তি ও দক্ষ-প্রশিক্ষিত-চৌকস জনবল নিয়ে একটি ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

উৎপল কুমার চৌধুরী আরও বলেন, আরএমপি কমিশনার মহোদয়ের দিকনির্দেশনায় আমরা সার্বিকভাবে চেষ্টা করছি আরএমপি এলাকা যেন সাইবার অপরাধমুক্ত হয়। রাজশাহী যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর একটা শহর, তেমনিভাবে অপরাধমুক্ত একটা শহর হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি। সর্বোপরি সাইবার ক্রাইম ইউনিট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নগরীর সকল অপরাধ ও অপরাধী শনাক্তকরন ও গ্রেফতারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই ইউনিট নগরবাসীর সেবায় সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

জানতে চাইলে আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক প্রতিবেদক কে  জানান, সাইবার ইউনিটে আমরা ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব যুক্ত করতেছি। আমেরিকান দূতাবাসের ATA(Anti Terrorism Assistance) আমাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করতেছে। এতে করে আমরা ডিজিটাল ফরেনসিক কাজগুলো এখানেই করতে পারবো।

তিনি আরও বলেন, সাইবার ক্রাইম ইউনিটের মাধ্যমে রাজশাহীতে দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে। রাজশাহীতে কোনো ক্রাইম নাই, ইভটিজিং নাই, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপরাধ বহুলাংশে কমে গেছে। ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব হয়ে গেলে ছোট ছোট ক্রাইমগুলোও থাকবে না।

প্রতিদিনই লোকজন সাইবার ক্রাইম ইউনিটে আসে। ভুক্তভোগীরা সহযোগিতা নিচ্ছে, সব ধরনের উপকার পেয়ে তারাও সন্তুষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি নগরীর শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে জানান আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক।